প্রকাশিত: Sat, Jan 14, 2023 3:43 PM
আপডেট: Sun, May 11, 2025 5:15 AM

প্রসঙ্গ স্কুলের নতুন পাঠ্যবই নিয়ে বিতর্ক

মারুফ মল্লিক

স্কুলের নতুন পাঠ্যবই নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। বিশেষ করে নিম্নমাধ্যমিকে ৬ষ্ঠ ও ৭ম  শ্রেণির ইতিহাস ও সমাজ বই নিয়ে বিতর্ক বেশি হচ্ছে। অনেক বিতর্কের মধ্যে একটি বিষয় নজরে আসলো। বলা হয়েছে, বখতিয়ার খলজি অসংখ্য বিহার ও লাইব্রেরি ধ্বংস করেছেন। আমি নিজে ইতিহাসের শিক্ষার্থী ছিলাম। কোনো বই বা আর্টিকেলে কখনো পড়ি নাই বখতিয়ার খলজি অসংখ্য বিহার ও লাইব্রেরি ধ্বংস করেছেন। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন স্নাতক ও স্নাতকত্তোর শ্রেণিতে আমরা ভারতীয় লেখকদের বই ও প্রবন্ধই পড়েছি। আমাদের সব বাঘা বাঘা ইতিহাসের অধ্যাপকরা স্নাতক ও স্নাতকত্তোর শ্রেণিতে পড়ানোর মতো কোনো বই লিখেননি। পুরো স্নাতক ও স্নাতকত্তোর শ্রেণিতে চবির অধ্যাপক এম এ করিমের বাংলার ইতিহাস প্রাচীন যুগ ও জাবির অধ্যাপক শাহনেয়াজের বিশ্ব সভ্যতার বই ছাড়া আমরা আর কোনো বই পড়িনি। আসলে পড়ার মতো বই নাই। তাই ভারতীয় অধ্যাপক যেমন আরসি মজুমদার, রাখাল দাস বন্দোপাধ্যায়, প্রভাতাংশু মাইতি ও কিরণচন্দ্র  চৌধুরীর বইই ভরসা ছিল। যারা বেশি পড়তে চাইতেন তারা অক্সফোর্ডের ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার হিস্ট্রি বই পড়তেন। 

এসব বইয়ে বখতিয়ার খলজি কর্তৃক অসংখ্য বিহার ও লাইব্রেরি ধ্বংসের কোনো উল্লেখ নাই। নালন্দা বিহার ধ্বংসের জন্য সম্প্রতি একটি শ্রেণি বখতিয়ার খলজিকে দায়ী করেন। কিন্তু বিভিন্ন ঐতিহাসিকদের মতে নালন্দা বিহার ধ্বংস করেছেন সেন বংশের প্রতিষ্ঠাতা হেমন্ত সেনের ছেলে বিজয়  সেন। এদের বসতি ছিল রাজশাহীর গোদাগাড়ী এলাকায়। লিপিতাত্ত্বিক (ঊঢ়রমৎধঢ়যরপ) রাধাকৃষ্ণ চৌধুরী গোদাগাড়ির দেও পাড়াতে প্রাপ্ত স্তম্ভ লিপি বিশ্লেষণ করে নিশ্চিত করেছেন, নালন্দা ধ্বংস করেছেন বিজয় সেন। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে পড়তে পারেন: ঈযধঁফযধৎু, জ. ১৯৭৮. উবপষরহব ড়ভ ঃযব টহরাবৎংরঃু ড়ভ ঠরশৎধসধংরষধ, ঔড়ঁৎহধষ ড়ভ ঃযব ওহফরধহ ঐরংঃড়ৎু, ঠড়ষ. খঠও, চধৎঃ ওও গবেষণা প্রবন্ধটি।

রাধাকৃঞ্চ চেীধুরী নালন্দায় ১৯৬০-৭২ সাল পর্যন্ত পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতাত্ত্বিক খননের উপর ভিত্তি করে উল্লেখিত প্রবন্ধে পরিষ্কারভাবে দেখিয়েছেন যে বখতিয়ার খলজীর বাংলা অভিযানের সঙ্গে নালন্দার ধ্বংসের কোনো সম্পর্কই ছিলো না। বখতিয়ার খলজি সম্পর্কে যে ঐতিহাসিক বিবরণ পাঠ্য বইয়ে দেওয়া হয়েছে তা অনৈতিহাসিক, অসত্য ও বিভ্রান্তিকর। লেখকরা বইয়ে কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্রও উল্লেখ করেননি। অনেকটা মনগড়া, নিজস্ব মতামত দিয়ে পাঠ্যপুস্তক রচনা করা হয়েছে। যা অনভিপ্রেত বলেই হচ্ছে। তবে ঐতিহাসিক অনেক ঘটনা নিয়েই বিতর্ক থাকে। স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় না। যেমন সম্রাট অশোকের ধর্ম বা আর্যদের আদিবাসস্থান সম্পর্কে ঐতিহাসিকরা কোনো একক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেননি। এরপরও বিহার ও লাইব্রেরি ধ্বংস করা নিয়ে যদি বখতিয়ার খলজির ভূমিকা উল্লেখ করতেই হয় তাহলে এই অঞ্চলে বৌদ্ধদের সমূলে বিনাশ করতে বহিরাগত সেন রাজবংশের ভূমিকারও উল্লেখ করা প্রয়োজন ছিল। সেনদের নির্বিচারে বোধিবৃক্ষ নির্ধনের কথাও পাঠ্যবইয়ে লেখা দরকার ছিল। তাহলে ইতিহাস রচনায় ভারসাম্য থাকতো। 

এছাড়াও বইগুলোতে নানা ধরনের অসংগতি ও অসামঞ্জস্য লক্ষ্য করা যায়। যেমন জমিদারী প্রথার প্রকারন্তরে গুণগানই করা হয়েছে। কৃষকের ভূমির মালিকানা হারানো ভূ-সামন্ত প্রথা কিভাবে সুবিধাজনক ছিল তা বোধগম্য হচ্ছে না। আমার কাছে মনে হয়েছে একদল অজ্ঞ লোকদিয়ে পাঠ্য পুস্তক রচনা করা হয়েছে। তথ্যের সত্যতা ও সোর্স সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া ইতিহাস পাঠ ও রচনার গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। গবেষণায় মূলত এসবই শিখানো হয়। বড় বড় ডিগ্রি থাকলেই বিজ্ঞ হওয়া যায় না। বিজেপির দাবি করা ইতিহাস আর পাঠ্যপুস্তকের ইতিহাসের মধ্যে পার্থক্য থাকে। পাঠ্যপুস্তকের লেখকরা মনে হয় এই পার্থক্যটা ভুলে গেছিলেন। তাই ভারতের বিজেপিপন্থী  লেখকদের দাবি করা তথ্য পাঠ্য বইয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। অবশ্য চিপাচাপা থেকে তথাকথিত ডিগ্রি প্রাপ্তরা এই পার্থক্য বুঝবেন না সেটাই স্বাভাবিক। ফেসবুক থেকে